২২ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

বিএনপির ইশতেহারে বিশেষ যা আছে

খালেদা জিয়া - ছবি : সংগৃহীত

আগামী ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এই নির্বাচন সামনে রেখে দুই প্রধান দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি তাদের রাজনৈতিক ইশতেহার ঘোষণা করেছে। নির্বাচনী ইশতেহারে দল দু’টি তাদের নিজ নিজ দলীয় রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে জাতির কাছে নানা প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করেছে। এটি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। যে প্রক্রিয়াটি এর আগের সব নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলো অব্যাহতভাবে চালু রেখেছে। প্রতিটি সরকারের মেয়াদ শেষে জনগণ বিবেচনা করে, দলটি ক্ষমতায় যাওয়ার আগে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তার কতটুকু বাস্তবায়ন করেছে, আর কতটুকু করতে ব্যর্থ হয়েছে। এ প্রতিশ্রুতি দিতে গিয়ে আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলের নেতারা অনেক সময় বাস্তবায়নযোগ্যতার দিকটা ভুলে গিয়ে বেশি মনোযোগী হয়ে ওঠেন কোন প্রতিশ্রুতি দিলে বেশি মাত্রার ভোটারদের কাছে টানা যাবে। ফলে অনেক প্রতিশ্রুতিই মেয়াদ শেষে বাস্তবায়নের বাইরে থেকে যায়। বর্তমান ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের বেলায় আমরা তেমনটি লক্ষ করেছি।

উদাহরণ টেনে বলা যায়, আওয়ামী লীগ প্রধান বলেছেন, আগামী নির্বাচন উপলক্ষে ঘোষিত এই ইশতেহার হচ্ছে ২০০৮ সালের ও ২০১৪ সালের ইশতেহারে ঘোষিত তার দলের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনারই ধারাবাহিকতা। তা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগের দেয়া কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রতিশ্রুতি ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর বাস্তবায়ন করেনি। এ নির্বাচনের আগে দলটি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ন্যায়পাল নিয়োগের। প্রতিশ্রুতি ছিল আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও জনপ্রতিনিধিদের কাজে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার। কতটুকু হয়েছে, তা জনগণই বলতে পারবে। প্রতিশ্রুতি ছিল দলটি প্রতি বছর শেষে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী ও তাদের স্বজনদের সম্পদের বিবরণী ও আয়ের উৎস জনসমক্ষে প্রকাশ করবে। দলটি আরো প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধের। ২০০৮ সালের ইশতেহারে প্রতিশ্রুতি ছিল সংসদে ১০০ মহিলা আসন সংরক্ষিত রাখা হবে, যারা নির্বাচিত হবেন জনগণের সরাসরি ভোটে। এসব প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন অপূর্ণ থেকেছে আজো। প্রতিশ্রুতি ছিল রাজনৈতিক সহিষ্ণুতা ও রাজনীতিতে সৌজন্যবোধ প্রকাশের, যা বাস্তবে দেখা যায়নি। এসব প্রতিশ্রুতি এখনো কাগজ-কলমেই রয়ে গেছে। ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচনের পরও আওয়ামী লীগ এসব ব্যাপারে নীরবতা অবলম্বনই করেছে। এই মেয়াদের ন্যায়পাল নিয়োগ হয়নি, ক্ষমতাসীনদের সম্পদের বিবরণ ও আয়ের উৎস জনগকে জানানো হয়নি। এর বাইরে দলটির প্রতিশ্রুতি ছিল রাজনৈতিক দলগুলো ও পেশাজীবীদের মধ্যে মৌলিক বিষয়াবলি প্রশ্নে একটি জাতীয় মতৈক্য গড়ে তোলার, যাতে দেশে গণতন্ত্র ও উন্নয়ন সুসংহত হয়। এসব প্রতিশ্রুতি অপূর্ণই থেকে গেছে।


সে যা-ই হোক, এবারের ইশতেহারে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পুরনো ধারায়ই নানা প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করেছে। ‘সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ’ শিরোনামে ইশতেহারের ২১টি বিশেষ অঙ্গীকার করেছে আওয়ামী লীগ। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রতিশ্রুতি হচ্ছে- গ্রামে নগরের সুবিধা সম্প্রসারণ, এক কোটি ৫০ লাখ লোকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা, মেগা প্রকল্পগুলোর দ্রুত ও মানসম্পন্ন বাস্তবায়ন, নিরাপদ সড়ক ও নিরাপদ খাদ্যের নিশ্চয়তা, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি, সন্ত্রাস, সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদ নির্মূল ইত্যাদি। অন্য দিকে বিএনপি প্রতিহিংসামুক্ত দেশ গড়ার লক্ষ্যে উল্লেখ করেছে ২১ দফা প্রতিশ্রুতি। উল্লেখযোগ্য প্রতিশ্রুতির মধ্যে রয়েছে : রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য আনা, পরপর দু’বার বেশি প্রধানমন্ত্রী না থাকার বিধান, গণমুখী প্রশাসন গড়ে তোলা, গণভোট পুনঃপ্রবর্তন ও সংসদের উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠা, এক কোটি নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি ইত্যাদি।

এখানে সবিশেষ লক্ষণীয়, বিএনপির দেয়া প্রতিশ্রুতিতে প্রতিহিংসামুক্ত রাজনীতি করা এবং প্রধানামন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার ভারসাম্যপূর্ণ রাজনীতি চালুর পাশাপাশি দুই মেয়াদের বেশি কারো প্রধানমন্ত্রী না হওয়ার বিধান চালুর মতো দেশে নতুন ধারার রাজনীতি প্রবর্তনের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি রয়েছে। বিএনপি প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করেছে, আগামী ভোটের মাধ্যমে দলটি ক্ষমতায় গেলে গণতন্ত্রের চর্চা করবে। সংবিধানের প্রয়োজনীয় সংশোধন করে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার মধ্যে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করবে। প্রধানমন্ত্রী সর্বোচ্চ দুই মেয়াদ থাকার বিধান চালু করবে। বিরোধী দল থেকে ডেপুটি স্পিকার করা হবে। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে সংসদ সদস্যদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করবে। সংসদে উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠা করা হবে। নির্বাচন পরিচালনার জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা চালু করবে, যাতে কোনো দল-জোট অসীম সময় পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকতে না পারে। বলা চলে, এসবই দেশে নতুন ধারার রাজনীতি প্রবর্তনের অঙ্গীকার, যা অনুপস্থিত রয়েছে আওয়ামী লীগের ম্যানিফেস্টোতে। নতুন ধারার রাজনীতি চালুর অঙ্গীকারের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গীকারটি হচ্ছে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার মধ্যে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার বিষয়টি।

আমরা যদি পেছন ফিরে থাকাই, তবে দেখতে পাবো স্বাধীন বাংলাদেশের প্রশাসন চলেছে মোটামুটি দুই ধরনের সরকারব্যবস্থার আওতায় : রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকার ও সংসদীয় সরকার। মাঝে কয়েক বছর ছিল সামরিক শাসন ও সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। আমাদের দেশের রাজনীতিবিদেরা ও বুদ্ধিজীবী মহল সাধারণত তাদের সমালোচনায় রাষ্ট্রপতিশাসিত ধরনের সরকারকে স্বৈরতান্ত্রিক সরকার হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন। ১৯৯১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত সময়ে আমরা পেয়েছি তিনটি পুরো মেয়াদের সংসদীয় ধরনের সরকার। এ সরকার তিনটি সরকার গঠিত হয়েছে মোটামুটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে, যাতে ব্যাপক অংশগ্রহণ ছিল ভোটারদের। তবে এসব সংসদীয় সরকারের বিরুদ্ধেও রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারগুলোর মতোই সমালোচনা ছিল গণতন্ত্রচর্চায় স্বৈরতান্ত্রিক আচরণের। বর্তমান সরকার দুই মেয়াদে ক্ষমতায় সংসদীয় সরকারব্যবস্থার আওতায়। বর্তমান সরকারের আমলে স্বৈরতান্ত্রিক শাসন পরিচালনার সমালোচনা এসেছে আরো প্রবলভাবে।

বলা যায়, উভয় ধরনের সরকারব্যবস্থাই আমাদের দেশে স্বৈরতান্ত্রিক আচরণের অভিযোগ জোরালো। উভয় ধরনের এই স্বৈরতন্ত্রের মৌল কারণ ছিল ‘এক-ব্যক্তির এককদলীয় নেতৃত্ব’, যেখানে বালাই ছিল না কোনো জবাবদিহির। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতা এর অন্যতম কারণ। কারা এতে নির্বাচিত হয়ে এসেছে, তা ছিল না কোনো বিবেচ্য। এ প্রেক্ষাপটে আমাদের দেশে একটি রাজনৈতিক সংস্কার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। আর এ সংস্কারে গুরুত্বপূর্ণ করণীয় হচ্ছে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার মধ্যে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা। আর সেই অঙ্গীকারটিই বিএনপি করল এবারের নির্বাচনী ইশতেহারের মাধ্যমে। এ জন্য বিএনপি প্রাথমিক মোবারকবাদটি পেতে পারে বৈকি!

আমরা রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকার ও সংসদীয় সরকার- এই দুই ধরনের সরকারের অভিজ্ঞতাই পেয়েছি। কিন্তু কোনো ধরনের সরকারই আমাদের সরকারের স্বৈরতান্ত্রিক আচরণ থেকে মুক্ত করতে পারেনি। এখন আমাদের প্রচেষ্টা হওয়া উচিত বিদ্যমান সংসদীয় সরকারব্যবস্থার আওতায় থেকেই রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার মধ্য একটা ভারসাম্য এনে এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ। অস্বীকার করার উপায় নেই বর্তমান শাসনব্যবস্থায় আমাদের দেশে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতার মধ্যে একটি চরম ভারসাম্যহীনতা বিরাজ করছে। বলা যায়, প্রধানমন্ত্রী এক ধরনের নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী। এর মাধ্যমে একজন প্রধানমন্ত্রী পরিবারতন্ত্র চালুর সহজ সুযোগ পাচ্ছেন। অন্য দিকে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতাকে রূপক অর্থে শুধু জানাজা পরার ক্ষমতায় নামিয়ে আনা হয়েছে। অন্য দিকে মন্ত্রী-এমপিদের কাজ করতে হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর হাতের পুতুল হয়ে।

এমনটি যাতে না হয়, সে জন্য বাংলাদেশে দীর্ঘ দিন থেকেই প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার মধ্যে ভারসাম্য আনার একটা তাগিদ বিভিন্ন মহল থেকে বিভিন্ন সময়ে উচ্চারিত হয়ে আসছে। কিন্তু প্রতিটি সরকারপক্ষই এ ব্যাপারে নীরবতা অবলম্বনের নীতি গ্রহণ করেছে। তবে সময়ের সাথে ও বাস্তবতার আলোকে এ দাবি দিন দিন জোরালো হচ্ছে। মনে হয় এখন সময় হয়েছে, বিষয়টি আমলে নেয়ার ও এ ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার। তবে এ ভারসাম্য আনার বিষয়টি খুব সহজ কোনো ব্যাপার নয়। তা সাধারণ মানুষের ভাবনার বিষয়ও নয়। কী করে এ ভারসাম্য আনা যায়, সে ব্যাপারে কাজ করার জন্য বিজ্ঞ ব্যক্তিদের সমন্বয়ে একটি কমিশন গঠন করা প্রয়োজন। সেই সাথে প্রয়োজন দেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একটি জাতীয় মতৈক্য গড়ে তোলা। না হলে এ ব্যাপারে কোনো সুফল বয়ে আনা কঠিন হবে। আমরা দেখেছি, বিএনপি এবারের নির্বাচনী ইশতেহারে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার মধ্যে ভারসাম্য আনার প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করেছে। বিএনপি বলেছে, ক্ষমতায় গেলে দলটি এ কাজটি করবে। কিন্তু আওয়ামী লীগ তা করেনি। আওয়ামী লীগ না চাইলে এ কাজটি কতটুকু সম্ভব হবে, তা নিয়ে সংশয় আছে।

আমরা জানি, আমাদের দেশে প্রধানমন্ত্রী দেশের প্রধান নির্বাহী ক্ষমতার অধিকারী। অধিকন্তু তিনি ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলেরও প্রধান। নীতিসংক্রান্ত প্রতিটি সিদ্ধান্ত অনুমোদিত হয় মসিন্ত্রসভায়। আর এ মন্ত্রিসভারও প্রধান হচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী। প্রতিটি মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরের যাবতীয় সিদ্ধান্ত প্রক্রিয়ার সাথে তার সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। তাকে না জানিয়ে কোনো নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব নয়। এসব দায়িত্ব পালনের পর প্রধানমন্ত্রীকে দলীয় প্রধানের দায়িত্বও পালন করতে হয়। দলীয় প্রধান হিসেবে সংবিধানের ৭০ নম্বর অনুচ্ছেদ সংসদে প্রধানমন্ত্রীকে একটি অনন্য ক্ষমতা দিয়েছে। সংবিধানের ৭০ (খ) অনুচ্ছেদে বলা আছে : সংসদে কোনো সদস্য তার দলের বিপক্ষে ভোট দিতে পারবেন না। তা হলে তার আসন শূন্য হয়ে যাবে। অতএব বলা যায়, বাংলাদেশে একজন প্রধানমন্ত্রী অপরিমেয় ক্ষমতার অধিকারী।

তা ছাড়া প্রধানমন্ত্রী তার নিজের ইচ্ছামতো সব সাংবিধানিক পদে নিয়োগের জন্য একটি প্যানেল তৈরি করে তা রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠান। এখানে রাষ্ট্রপতির ইচ্ছা-অনিচ্ছার স্থান খুব একটা নেই। সে জন্যই কেউ কেউ মনে করেন, এ নিয়মের পরিবর্তে সাংবিধানিক পদগুলো পূরণের জন্য প্যানেল তৈরি করার দায়িত্ব দেয়া যেতে পারে একটি কমিশনকে। কমিশনের তৈরি করা প্যানেল থেকে রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর সাথে পরামর্শ করে সাংবিধানিক পদে কাউকে নিয়োগ দেবেন। তা ছাড়া মন্ত্রিসভায় প্রধানমন্ত্রীর নিরঙ্কুশ ক্ষমতায় একটি ভারসাম্য রক্ষার জন্য মন্ত্রিসভার ১০ শতাংশ মন্ত্রী নিয়োগের দায়িত্ব দেয়া যেতে পারে রাষ্ট্রপতিকে।

রাষ্ট্রপতি তার বিবেচনায় সৎ ও যোগ্য ও নির্দলীয় ব্যক্তিদের মন্ত্রিসভার এই ১০ শতাংশ সদস্য পদে নিয়োগ দেবেন, প্রধানমন্ত্রীর সাথে কোনো পরামর্শ না করেই। একইভাবে প্রধানমন্ত্রীর সাথে কোনো পরামর্শ না করেই রাষ্ট্রপতি নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক জরুরি পরিস্থিতিতে আংশিক বা পুরোপুরি জরুরি অবস্থা জারি করার ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবেন। প্রধানমন্ত্রী যাতে স্বৈরতান্ত্রিক আচরণ অবলম্বন করতে না পারেন, সে জন্য এমন ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে যে, যিনি প্রধানমন্ত্রী হবেন তিনি দলীয় প্রধানের পদে থাকতে পারবেন না। যখন কোনো দল নির্বাচনে বিজয়ী হবে, তখন ওই দলের মনোনীত ব্যক্তি হবেন প্রধানমন্ত্রী। দলীয় প্রধান যদি প্রধানমন্ত্রী হতে চান, তবে তাকে দলীয় প্রধানের পদ ছেড়ে দিতে হবে। বিদেশে হাইকমিশনার ও রাষ্ট্রদূত নিয়োগের একক ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর হাতে না রেখে, প্রধানমন্ত্রীকে এ কাজটি করতে হবে রাষ্ট্রপতির সাথে পরামর্শক্রমে।

রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য প্রশ্নে ফরাসি সংবিধান বেশ আলোচিত একটি বিষয়। বলা হয় কিংবা মনে করা হয়, সংসদীয় ব্যবস্থার সুষ্ঠু পরিচালনা বাধাগ্রস্ত হয় বিভিন্ন কারণে। কারণ এ ব্যবস্থার রয়েছে বেশ কিছু অন্তর্নিহিত দুর্বলতা ও সীমাবদ্ধতা। এ সীমাবদ্ধতা ও দুর্বলতার মূলে রয়েছে সংশ্লিষ্ট দেশটির রাজনৈতিক সংস্কৃতি। এ কারণে সংসদীয় সরকারব্যবস্থাও নানা প্রশ্নের মুখোমুখি হচ্ছে। সে কারণেই ফরাসি মডেলটি অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে। ফিফথ রিপাবলিকের সংশোধিত ১৯৫৮ সাল থেকে কার্যকর সংবিধানটি বিবেচনায় নিলে দেখা যায়, এই সংবিধান সম্পর্কিত সত্যটি হচ্ছে, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার নামে কার্যত প্রেসিডেন্টকে করা হয়েছে কিছু কিছু ক্ষেত্রে অধিকতর ক্ষমতাধর।

যেমন উদাহরণ টেনে বলা যায়, প্রেসিডেন্ট প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে পার্লামেন্ট ভেঙে দিতে পারেন, সুনির্দিষ্ট ধরনের কিছু বিল উপস্থাপন অথবা রেফারেন্ডামের ট্রিটি গ্রহণ কিংবা বাতিল করতে পারেন। প্রেসিডেন্ট প্রধানমন্ত্রী কিংবা পার্লামেন্টকে এড়িয়ে তিনি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে গণভোটের আয়োজন করতে পারেন। তিনি কাউন্সিল অব মিনিস্টার্সের বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন। তিনি একান্তভাবে সম্পন্ন করেন বৈদেশিক ও নিরাপত্তাসংক্রান্ত বিষয়াবলি, যখন প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্ট পার্লামেন্টে একই দল থেকে হন না। এ অবস্থাকে বলা হয় কো-হেভিটেশন। এমনটি ঘটেছিল ১৯৮৬-৮৮ সময়ে, যখন প্রেসিডেন্ট ছিলেন সোশ্যালিস্ট মিতেরাঁ ও প্রধানমন্ত্রী ছিলেন নয়া ডানপন্থী গলিস্ট জ্যাক সিরাক। ১৯৫৮ সালের ফরাসি সংবিধানে রয়েছে দু’টি মৌলিক বৈশিষ্ট্য : প্রথমত, নির্বাহী ক্ষমতা ভাগ করা হয়েছে দু’টি অর্গানে : রাষ্ট্রপ্রধান ও প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন সরকারে।

প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নীতিপ্রণয়ন ও নীতি অনুমোদন। দ্বিতীয়ত, সরকার সামগ্রিকভাবে দায়িত্বে থাকবে ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির। তৃতীয় ও চতুর্থ রিপাবলিকের পতনের পর জেনারেল দ্যগল যথাসময়ে সঠিকভাবে অনুধাবন করেন, তথাকথিত পার্লামেন্টারি সিস্টেমের নামে একজন টিটুলার রাষ্ট্রপ্রধান জাতীয় ঐক্য অর্জন, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের সমাধান হতে পারে না। তার স্লোগান ছিল, ‘ফ্রেন্স নাউ নিডস অ্যা স্ট্রঙ্গার প্রেসিডেন্ট’। তৎকালীন প্রেক্ষাপটে এটি যৌক্তিক বলে বিবেচিত। এই সরকারব্যবস্থা সেমি-প্রেসিডেন্সিয়াল সিস্টেম নামেও পরিচিত’। আমরা চাই এমন একটি ব্যবস্থা, যেখানে অতি ক্ষমতাধর হবেন না রাষ্ট্রপতি কিংবা সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হবেন না একজন প্রধানমন্ত্রী। চাই রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার যৌক্তিক ভারসাম্য, যার ফলে প্রধানমন্ত্রী কিংবা রাষ্ট্রপতি কারোরই স্বৈরশাসক হওয়ার সুযোগ থাকবে না। সেটিই হবে আমাদের জন্য নতুন ধারার রাজনীতি।

বিএনপির ইশতেহারে এই নতুন ধারার রাজনীতি করার অঙ্গীকার হিসেবে বলেছে, যদি ক্ষমতায় যায় তবে দলটি প্রতিহিংসার রাজনীতি করবে না, প্রতিহিংসামুক্ত দেশ গড়বে। এটি দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় ব্যাপক সংস্কার আনবে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করবে, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করবে। দলটি মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করবে। থাকবে না কোনো কালো আইন। বাতিল করবে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন ও বিশেষ ক্ষমতা আইন ও অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের মতো কালো আইন। দলটি আরো অঙ্গীকার করেছে প্রশাসনে সংস্কার করার। একটি কমিশন গঠন করবে, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ। সরকারি সংস্থাগুলোকে করবে আরো শক্তিশালী। সর্বোপরি রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় আনার ভারসাম্য।

আমরা যদি বিএনপির নির্বাচনী ইশতেহারটি ভালো করে পড়ে দেখি তবে দেখা যাবে, দলটি ক্ষমতায় গেলে যদি এর নির্বাচনী অঙ্গীকারগুলো আন্তরিকভাবে বাস্তবায়ন করে তবে সত্যি সত্যিই দেশে এমন একটি নতুন ধারার রাজনীতি চালু হবে, যার জন্য এ দেশের প্রতিটি মানুষ আগ্রহের সাথে অপেক্ষা করছে। মানুষ চায় না আরেকটি রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা ঘটুক। মানুষ চায় নিরাপদে নিজ নিজ কাজ করার নিশ্চয়তা। সে পথই হোক আমাদের সবার চলার পথ।


আরো সংবাদ



premium cement